Sunday, October 27, 2019

দরজার ওপাশে

তখন আমি ক্লাস নাইনে। পড়তাম মাদারীপুর সদর স্কুলে। প্রতিদিন সকাল আটটায় বাসা থেকে বের হতাম স্কুলের  উদ্দেশ্যে। যে রোড দিয়ে স্কুলে  যেতাম ঐ রোডে একটি বাড়ি ছিল নাম মিতানূর প্যালেস।আমি যখন মিতানূর প্যালেসের সামনে  আসতাম ঠিক তখনই ঐ বাড়ি থেকে স্কুলড্রেস পড়া একটি মেয়ে বেড়িয়ে আসতো ।এরপর আমার পিছু পিছু হেটে স্কুলে যেত।রাস্তার মোড়ে কানু ভিখিরিকে আমি যখন এক টাকা দেওয়ার জন্য থামতাম তখন পিছন ফিরে দেখতাম থমকে যাওয়ার মত দাড়িয়ে আছে মেয়েটা।যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে।  মাঝখানে আমি ওকে কয়েকদিন দেখিনি।মেয়েটার সাথে আমার কখনো  কথা হয়নি কিন্তু কেন জানি ওর প্রতি আমার একটা অন্য রকম একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছে ততদিনে ।তাই ঐ রোড দিয়ে যাওয়ার সময় মিতানূর প্যালেসের গেটে আমার রেটিনার লেন্স প্রায়ই ওকে খুঁজে ফিরতো। কয়েকদিন পর  আবার ওকে দেখতে পেলাম। আমার মন এক অজানা আনন্দে ভরে গেল।তারপর মেয়েটার আবার সেই পিছু পিছু হাঁটা শুরু হলো । ফাইনাল পরীক্ষা শেষ আমার ।ক্লাস টেনে উঠলাম। নতুন ক্লাস শুরু হল।তো একদিন ক্লাসে যাওয়ার পথে ডাকলাম মেয়েটাকে ।ও ভয়ে ভয়ে কাছে আসলো।বললাম "কি সমস্যা তোমার?পিছনে পিছনে হাটো কেন?নাম কি? কোন ক্লাসে পরো?" মেয়েটি ভয় পাওয়া কাঁপা গলায় বললো "সুস্মিতা,সেভেন।" বলেই দৌড়ে পালালো।বুঝলাম নাম সুস্মিতা, ক্লাস সেভেনে পরে। তবে এরপর থেকে সুস্মিতাকে আর আমার পেছনে পেছনে হাটতে হয়নি।পাশাপাশিই হাটতো ও।স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার স্বাংস্কৃতিক পর্বে স্বরচিত একটা কবিতা পড়েছিলাম, সেই থেকে নাকি ওর এই পিছু হাটা শুরু। এরপর দু'জনে গল্প করতে করতে স্কুলে যেতাম।আমি কখনো স্কুলে টিফিন নিয়ে আসতাম না,সুস্মিতা আনতো।এখন থেকে আরো বেশী করে আনা শুরু করলো।টিফিন পিরিয়ডে প্রায়ই ডাক পড়তো আমার। রেইনট্রি তলায় বসে দুজনে খেতাম।ওর টিফিন ক্যারিয়ার থেকে একটার পর একটা খাবার বেরিয়ে আসতো। একদিন জিজ্ঞেস করলাম" আচ্ছা, আমি যখন তোমাদের মিতানূর প্যালেসের সামনে আসি, দেখি ঠিক তখনি তুমি বেরিয়ে আসো।কিভাবে?"ও বললো "তুমিতো সোয়া আটটায় আমাদের বাসার সামনে আসো আমি পৌনে আটটা থেকেই গেটের পেছনে দাড়িয়ে থাকি।"আমি বললাম "কি দরকার এসবের? " ও বললো" দরকার হয়তো নেই,তবে ভাল লাগে।আর এই ভাল লাগাটা ধরে রাখতে আমি সারা জীবন তোমার জন্য দরজার পেছনে দাড়িয়ে থাকতে চাই।"আমি বললাম "তোমাদের ওটাতো গেট,দরজা না।" ও বললো" আশ্চর্য! দরজা কি কখনো হবে না?" বুঝলাম রাগ করেছে। বললাম" শরতের ঐ সাদা মেঘের উপরে একজন আছেন,তিনি নাকি মানুষের সকল নেক আশা পূর্ণ করেন। তার কাছে প্রার্থনা করো। "সেদিন দুজনে একসাথে ফিরছিলাম। হঠাৎ ও আমার শার্ট টেনে ধরে বললো"এই শোনো, কালকে আমার জন্য একটা কবিতা লিখে নিয়ে আসবে" কবিতা!কি করবে তুমি?কি করবো?আমার কাছে রেখে দেব।নিয়ে আসবে কেমন?আমি বললাম" আচ্ছা আনবো।"রাতভর সুস্মিতার জন্য কবিতা লিখলাম।কিন্ত সকালে আর বিছানা থেকে উঠা হলো না।ধরলো ম্যালেরিয়ায়।হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলাম টানা একমাস পর।পরদিনই বই খাতা আর পকেটে কবিতা নিয়ে ছুটলাম স্কুলের দিকে।মিতানূর প্যালেস পার হয়ে গেলাম কিন্ত সুস্মিতা আর বের হল না। বিষন্ন মনে স্কুলে গিয়ে ওর বান্ধবীদের খুজতে লাগলাম।তেমন কাউকে পেলাম না, যা দু-একজন পেলাম তারা তেমনভাবে কিছু বলতে পারলো না।রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা মনে পড়ল"মহা আশংকা জপিছে মৌন মন্তরে,সব সংগীত গেছে ইংগিতে থামিয়া।"আমারও সবকিছু যেন কেমন গুলিয়ে গেল।চারপাশে কতকিছু কিন্তু সবকিছু যেন কি এক অজানা আশংকায় থেমে আছে।আবার হাটা শুরু করলাম বাড়ির দিকে।মিতানূর প্যালেসের গেটের সামনে এসে আমার পা যেন আটকে গেল।দাড়িয়ে পড়লাম আমি।গেট দিয়ে কখন যে আংকেল টাইপ একটা লোক বেরিয়ে আমার সামনে এসে দাড়িয়েছে,খেয়ালই করিনি আমি।লোকটা গলা খাকারিতে সম্বিত ফিরে পেলাম।বললাম "এখানে সুস্মিতা'রা থাকতো না" হ্যা থাকতো, তবে ওরাতো কয়েকদিন আগে অন্য শহরে চলে গেছে। তুমিকে?আমি কে সেটা বিবেচ্য নয় তাই উত্তর দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করলাম না।চোখের পানি এড়াতে মাথা নিচু করে চলে আসলাম।  সেইদিনের পর থেকে আমার বাকি স্কুলজীবনে ঐ রোডে আমি আর কখনো যাইনি।এরপরে আহ্নিক গতির যথারীতি আবর্তনে কেটে গেছে অনেক বছর। আমিও আর সেই আগের আমি নেই।কাজ শেষে ক্লান্ত আমি বাসায় ফিরে দরজার কলিং বেলে চাপ দিতে না দিতেই দরজা খুলে গেলো।দেখি দরজার ওপাশে দাড়িয়ে সে। আমি সেই সূদুরে ফিরে গেলাম।"এই কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকবে,এসো।" সম্মোহন ভাঙলো স্ত্রী মালিহার কথায়। একমুখ বিস্ময় নিয়ে ফিরে এলাম সুস্মিতা থেকে মালিহা'য়।